শংকর দত্ত, কলকাতা: প্রায় এক বছর তিন মাস পর আজ দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসতে চলেছেন এই মুহূর্তে গোটা দেশে তাঁর সব থেকে বিরোধী হিসাবে পরিচিত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর এই বৈঠক ঘিরেই যত জল্পনা। রাজ্যের বিরোধীরের বক্তব্য, আসলে এই সখ্যাত মূলত সিবিআই এর কব্জা থেকে রাজীব কুমারকে রক্ষা করা। যাঁর মাধ্যমে আসলে কৌশলে সারদা কেলেঙ্কারি কান্ডে নিজের ভাইপো আর নিজেকে বাঁচানোই তাঁর মূল উদ্দেশ্য। যদিও মঙ্গলবার দিল্লি যাওয়ার আগে কলকাতা বিমানবন্দরে তিনি সাংবাদিকদের জানান, এই বৈঠক নিয়ে মিথ্যে জল্পনার কোনও মানে নেই। রাজ্যের দাবি-দাওয়ার জন্যই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন।
এদিন তিনি সাংবাদিকদের বলেন, রাজ্যের বেশ কিছু পাওনা-গুন্ডা আছে কেন্দ্রের কাছে, এ ছাড়া রাজ্যের নাম বদলের বিষয়েও কথা আছে, তাই দিল্লি যাচ্ছি। এদিন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘৩৬৫ দিনই রাজ্যে থাকি,ইদানিং আর দিল্লি যাওয়া হয় না। দিল্লি গেলে আরও বিশেষ কাজও করা যায়। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবার সময় আরও বিষয় উঠতে পারে।’ কথা হলো এই সময়টাকেই বৈঠকের জন্য বেছে নেওয়া হলো কেন? বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছেন মূলত এই বিষয়টি নিয়েই। অনেকেই বলছেন কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার রাজীবকুমার কে গ্রেফতার করতে সিবিআই যেভাবে উঠে পড়ে লেগেছে,সেটা রুখতেই মূলত তাঁর এই সফর। কারণ রাজীবকে ধরা মানেই কান টানলে মাথা আসবে। অবশ্যম্ভাবী ভাবে তাঁর ভাইপো ও তাঁর নাম উঠে আসতে পারে সারদা কেলেঙ্কারির সঙ্গে। তদন্ত থামতেই তাঁর দিল্লি যাত্রা বলে ধারণা রাজনৈতিক মহলের একাংশের।
লোকসভার বিরোধী দলনেতা তথা বহরমপুর-এর সংসদ স্পষ্টই বলেন, ‘এটা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সেটিং করতে যাওয়া ছাড়া কিছুই নয়। আসলে উনি বুঝতে পেরেছেন এখনই না গেলে ভাইপোকে আর বাঁচানো যাবে না। অন্যদিকে সিপিএম নেতা প্রাক্তন সংসদ শমীক লাহিড়ীর বক্তব্য, এর আগেও উনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জরুরি বৈঠক করতে গেছেন। কিন্তু বৈঠকটা ঠিক কি নিয়ে হলো সেটা আর মানুষ জানতে পারেন না। ওনার এতদিন পর এই হঠাৎ বৈঠকের উদ্দেশ্যটা ঠিক কি সেটা জানতে হবে।’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি দীলিপ ঘোষ অবশ্য বলেন, “ওনার যদি উদেশ্য রাজীব কুমারকে বাঁচানো হয়, সেটা লাভ হবে না। উনি বড় ভুল করবেন। উনি হয়তো মাথা বাঁচাতেই যাচ্ছেন।” তাঁকে ছাপিয়ে যায় বিজেপির কেন্দ্রীয় সম্পাদক রুহুল সিনহা। তাঁর কথায় উনি যতই মিটিং করুন সিবিআই পাতাল থেকেও রাজীব কুমারকে খুঁজে বের করবে। যাদের জন্য এত সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন,তাঁদের প্রত্যেকের শাস্তি পেতে হবে।
সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, উনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যেতেই পারেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে এই সময় টাকে বেছে নেওয়ায়। কানে টান পড়তেই কি উনি মাথা বাঁচাতে চললেন!”
বস্তুত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এই সফর নিয়ে জোর জল্পনা। কারণ এর আগে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তাঁর শেষ একান্ত বৈঠক হয় ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল। আর শেষ দেখা হয় গত বছর ২৫ মে বিশ্বভারতীর সমাবর্তন অনুষ্ঠানে। যেখানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর পর থেকে শুধুই বিরোধিতা। লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশ থেকে বিজেপি হটানোর ডাক তিনিই দিয়েছিলেন। এমনকি আগামী দিনে বাংলাই দেশকে পথ দেখাবে এই আওয়াজ তুলে তিনি বিজেপি বিরোধী ফেডারেল ফ্রন্ট গঠন করেছিলেন। যেখানে দেশের সমস্ত বিরোধী দলকে এক মঞ্চে আনতে চেষ্টা করেছিলেন।
নির্বাচনের আগে একাধিক প্রচারে তিনি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে ব্যক্তি আক্রমণ করেছেন। এমনকি তিনি প্রধানমন্ত্রী কে মিষ্টি পাজামা-পাঞ্জাবি উপহার দেন এই তথ্য নরেন্দ্র মোদী প্রকাশ্যে আনায় মমতা ব্যঙ্গ করে বলেন এর পর মিষ্টির বাক্সে নারী-পাথর পাঠাবো বলে। কেন্দ্রে বিজেপির সাপথ গ্রহন অনুষ্ঠানেও যাননি। যাননি সরকারের একদায়িক জরুরি বৈঠকে। লোকসভায় ও রাজ্য সভায় এনারসি,তিন তালাক বিল এমনকি কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধরা রোদ এ তার দল বিরোধিতা করেন। মোদী বিরোধিতা করতে তিনি “দেশে সুপার ইমারজেন্সি চলছে” বলেও কদিন আগেই মন্তব্য করেন।
এই অবস্থায় এত তীব্র বিরোধিতার সঙ্গে সঙ্গেই মুখ্যমন্ত্রীর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার এই হঠাৎ সফর নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে। যদিও কেউ কেউ বলছেন মঙ্গলবার ছিল প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন। আর এই জন্মদিন ও প্রাক-পূজোর শুভেছা বিনিময়ের মধ্যেই সিবিআই নিয়ে নতুন পথের সন্ধানই তাঁর আসল উদ্দেশ্য।
যদিও রাজ্যের বর্ষীয়ান মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের দাবী, “মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রের কাছে যান না বলে বিরোধীরা অভিযোগ করেন। আবার রাজ্যের বিশেষ প্রয়োজনে তিনি যাচ্ছেন বলেও অভিযোগ। আসলে এ রাজ্যের বিরোধীরা জানেনই না ঠিক কি পথ নেবেন তাঁরা।” যদিও রাজনৈতিক বিসেজ্ঞদের একাংশের অভিমত, মমতা পুজোর শুভেছা জানাতেই হয়তো যাচ্ছেন মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে বা কুর্তা-পাঞ্জাবি নিয়ে। তবে ঠিক এই মুহূর্তে রাজীব কুমারকে সিবিআই এর তৎপরতা দেখার সময়ই হঠাৎ তাঁর এই তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত দেখেই সন্দেহ হবে মানুষের। এখন সময়ই বলবে এটা তার ‘সেটিং- সফর’ নাকি রাজ্যের পাওনা আদাইয়ের জন্যই বিশেষ সখ্যাৎকার।
sweta